আমাদের সংস্কৃতি বিমূখতা
বিজ্ঞানের পরিভাষায় পৃথিবীতে যত জীব রয়েছে তাদের প্রাণের একক হলো তিনটি মৌলিক পদার্থ-অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন।সৃষ্টির সূচনালগ্নে এই তিনটি মৌলিক পদার্থের দ্বারাই প্রথম প্রাণের উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছিল।ঠিক তেমনি বিশেষ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত, স্বাতন্ত্র্য একটি জাতির প্রাণের একক হলো তার নিজস্ব সংস্কৃতি।বিজ্ঞ পাঠক-পাঠিকারা বোধহয় অবগত সংস্কৃতি কাকে বলে।তবুও আলোচনার পূর্বে নির্ধারিত বিষয়টির উপড় সংজ্ঞামূলক তথ্য প্রদানের দাবী রাখে।সংস্কৃতি-এক কথায় সাধারণ ভাবে বলতে গেলে সংজ্ঞাটা ধারায়, "কোনো একটা জাতিগোষ্ঠির যে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকলাপ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা-কৃষ্টি, বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনধারা রয়েছে তার সামগ্রিক ভাবই হলো সংস্কৃতি"।পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা ১১ টি ভিন্ন ভাষাভাষির জাতিগোষ্ঠি বসবাস করি।আমাদের আদিকাল হতেই নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে।
কিন্তু আমাদের মধ্যে যে অভিন্ন মিলটা বিদ্যমান তা হলো আমরা সবাই পাহাড়ে বসবাস করি এবং জুমচাষ করি।তাই আমাদের বৃহত্তর পরিচয়টি হলো আমরা সবাই জুম্ম।কিন্তু বর্তমানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থাটা ভালো নয়।আমাদের অস্তিত্ব হুমখীর মূখে।অস্তিত্ব সংকটের এই সমস্যা কেবল রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়,সাংস্কৃতিকগত ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়।
"আরমাজানাত তুয়োঙ তুলি লুদুঙ, মনের মতন সমার পেদুঙ বিঝুত বেরেদুঙ।"-এটি একটি চাকমা লোকগীতির পঙতি।যাকে উভগীত বলা হয়।আপনি যদি আধুনিক চামড়ার ছেলে মেয়েদের সামনে এই গানটি বাজান তাহলে দেখবেন তারা হাসাহাসি করতেছে, এমনকি নিজেদের এই মহামূল্যবান সম্পদটিকে কটু ভাষায় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেও তারা পিছপা হবে না।তাদের কানে প্রশান্তি এনে দেবার জন্য না জানি কত নাম না জানা শিল্পী কিংবা ব্যান্ডের গান শোনাতে হবে তা আপনার ধারণার বাইরে।তাদের বিন্দুমাত্রও চিন্তা নেই নিজের পবিত্র, সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ব্যাপারে।পথেঘাটে কিংবা বাসাবাড়িতে, যেখানে সেখানে দেখা যায় যে লোকজন এমন একটা বিদঘুটে ভাষায় কথা বলছে যার অর্ধেক বাংলা, অর্ধেক চাকমা।এসবের মানে কী? গাড়িতে উঠলে প্রায়শই দেখা যায় কতগুলো মোটা চামড়ার অতিরিক্ত ভদ্র চাকমাদের।তারা কত সহজে তাদের নিজস্ব মাতূভাষাকে দূষিত করছে।দেখা যায় ড্রাইভারকে বলতেছে "সামনে" তা সে ড্রাইভারটা হোক চাকমা, হোক বাঙালি।"সামনে" শব্দটার বদলে তারা কি বলতে পারত না "মুজুঙে" শব্দটি? এখন তো চাকমার আর "এ্যারা" খায়না, তারা খায় মাংস।
চাকমা ভাষার প্রকৃত শব্দ গুলে ভুলে গিয়ে প্রতিনিয়ত বাইরের শব্দ ঢুকিয়ে প্রাঞ্জল, সহজ, সরল ভাষাটাকে দুরভেদ্য করে তোলা হচ্ছে।এভাবে অনেক শব্দ বদলে গেছে।যেমন: চাগালার বদলে এলাকা, অকত এর বদলে সময়, গম এর বদলে ভালো।অন্তত ৫০০ এর অধিক শব্দ হালাতে বসেছে শুধুমাত্র আমাদের খাম খেয়ালি পনায়।আপনারা কেউ যদি কথা বলার সময় লক্ষ্য করবেন শতকরা ৮০ ভাগ বাংলা শব্দ ব্যবহার করছেন।এটা কি কখনো কাম্য? এবার আসি পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে।চাকমা সমাজে পুরুষরাতো ইতিমধ্যে পুরোনো সেই পোশাকের মহিমা হারিয়ে ফেলেছে।বাকি রয়েছে শুধু নারীদের পিনোন হাদি।কিন্তু বর্তমানে তারাও এসব পড়তে প্রায়শই অপারগতা প্রকাশ করে।আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে হবে এটা ঠিক।তাই বলে তাল মেলাতে গিয়ে নিজের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিতে হবে? আজকাল রাস্তা ঘাটে মেয়েরা এমন পোশাক পরিচ্ছদ পড়ে ঘুরে বেরায় দেখলে মনে হয় এই বূঝি কোনো এক পশ্চিমা দেশে চলে এলাম।প্রতিনিয়ত নানাভাবে পচে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি।
সীমাবদ্ধতার কারণে আমারা আমাদের অক্ষর গুলো শিখতে পারি না ঠিকই, কিন্তু আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে নিজ উদ্যেগে আমরা স্ব স্ব অক্ষর গুলো চর্চা করতে পারি।বর্তমানে নিজ উদ্যেগে চর্চা তো দূরের কথা কেউ যদি শিখতে যায় তাকে অনেকে বৈদ্য বৈদ্য বলে চেচাঁয়।এই হলো কাহিনী।এসবের জন্য দায়ী কে ? অবশ্যই আমরা।
রাষ্ট্রযন্ত্রকে দোষ দিলেও হবেনা।আমাদেরকে নিজেরদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে।একটা গাছের পাতা যখন সব ঝরে যায় তখন গাছটি প্রায় মৃতবৎ হয়।ঠিক তেমনি একটি জাতির সংস্কৃতি যদি ধ্বংস হয় তাহলে সেই জাতির ভেতরে ভেতরে মারা যায়।যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে একদিন হয়তো আমরা শুধু চাকমা কিংবা মারমা নাম নিয়ে বেচে থাকবো কিন্তু ভেতরে কিছু থাকবে না।আরেকটা সময় হয়তো আসতে পারে যে আমরা একেবারেই নাই হয়ে গেছি।তখন হয়তো জাদুঘরে শুধু আমাদের ম্যানোকুইন গুলো থাকবে আমরা থাকবো না।বইয়ের পাতায় লেখা থাকবে একটা সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা , ত্রিপুরা নামে কিছু আদিবাসি থাকতো তারা জুম্ম নামেও পরিচিত কিন্তু বর্তমানে ডাইনোসরদের মতো কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে চিরতরে।
তখন হয়তো নৃতত্ত্ববিদেরা আমাদের ফসিলগুলো উদ্ধার করবে এবং আমাদের জীবন যাপন সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবে।
লেখক:করুণ জ্যোতি চাকমা
কিন্তু আমাদের মধ্যে যে অভিন্ন মিলটা বিদ্যমান তা হলো আমরা সবাই পাহাড়ে বসবাস করি এবং জুমচাষ করি।তাই আমাদের বৃহত্তর পরিচয়টি হলো আমরা সবাই জুম্ম।কিন্তু বর্তমানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থাটা ভালো নয়।আমাদের অস্তিত্ব হুমখীর মূখে।অস্তিত্ব সংকটের এই সমস্যা কেবল রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়,সাংস্কৃতিকগত ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়।
"আরমাজানাত তুয়োঙ তুলি লুদুঙ, মনের মতন সমার পেদুঙ বিঝুত বেরেদুঙ।"-এটি একটি চাকমা লোকগীতির পঙতি।যাকে উভগীত বলা হয়।আপনি যদি আধুনিক চামড়ার ছেলে মেয়েদের সামনে এই গানটি বাজান তাহলে দেখবেন তারা হাসাহাসি করতেছে, এমনকি নিজেদের এই মহামূল্যবান সম্পদটিকে কটু ভাষায় ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেও তারা পিছপা হবে না।তাদের কানে প্রশান্তি এনে দেবার জন্য না জানি কত নাম না জানা শিল্পী কিংবা ব্যান্ডের গান শোনাতে হবে তা আপনার ধারণার বাইরে।তাদের বিন্দুমাত্রও চিন্তা নেই নিজের পবিত্র, সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ব্যাপারে।পথেঘাটে কিংবা বাসাবাড়িতে, যেখানে সেখানে দেখা যায় যে লোকজন এমন একটা বিদঘুটে ভাষায় কথা বলছে যার অর্ধেক বাংলা, অর্ধেক চাকমা।এসবের মানে কী? গাড়িতে উঠলে প্রায়শই দেখা যায় কতগুলো মোটা চামড়ার অতিরিক্ত ভদ্র চাকমাদের।তারা কত সহজে তাদের নিজস্ব মাতূভাষাকে দূষিত করছে।দেখা যায় ড্রাইভারকে বলতেছে "সামনে" তা সে ড্রাইভারটা হোক চাকমা, হোক বাঙালি।"সামনে" শব্দটার বদলে তারা কি বলতে পারত না "মুজুঙে" শব্দটি? এখন তো চাকমার আর "এ্যারা" খায়না, তারা খায় মাংস।
চাকমা ভাষার প্রকৃত শব্দ গুলে ভুলে গিয়ে প্রতিনিয়ত বাইরের শব্দ ঢুকিয়ে প্রাঞ্জল, সহজ, সরল ভাষাটাকে দুরভেদ্য করে তোলা হচ্ছে।এভাবে অনেক শব্দ বদলে গেছে।যেমন: চাগালার বদলে এলাকা, অকত এর বদলে সময়, গম এর বদলে ভালো।অন্তত ৫০০ এর অধিক শব্দ হালাতে বসেছে শুধুমাত্র আমাদের খাম খেয়ালি পনায়।আপনারা কেউ যদি কথা বলার সময় লক্ষ্য করবেন শতকরা ৮০ ভাগ বাংলা শব্দ ব্যবহার করছেন।এটা কি কখনো কাম্য? এবার আসি পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে।চাকমা সমাজে পুরুষরাতো ইতিমধ্যে পুরোনো সেই পোশাকের মহিমা হারিয়ে ফেলেছে।বাকি রয়েছে শুধু নারীদের পিনোন হাদি।কিন্তু বর্তমানে তারাও এসব পড়তে প্রায়শই অপারগতা প্রকাশ করে।আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে হবে এটা ঠিক।তাই বলে তাল মেলাতে গিয়ে নিজের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিতে হবে? আজকাল রাস্তা ঘাটে মেয়েরা এমন পোশাক পরিচ্ছদ পড়ে ঘুরে বেরায় দেখলে মনে হয় এই বূঝি কোনো এক পশ্চিমা দেশে চলে এলাম।প্রতিনিয়ত নানাভাবে পচে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি।
সীমাবদ্ধতার কারণে আমারা আমাদের অক্ষর গুলো শিখতে পারি না ঠিকই, কিন্তু আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে নিজ উদ্যেগে আমরা স্ব স্ব অক্ষর গুলো চর্চা করতে পারি।বর্তমানে নিজ উদ্যেগে চর্চা তো দূরের কথা কেউ যদি শিখতে যায় তাকে অনেকে বৈদ্য বৈদ্য বলে চেচাঁয়।এই হলো কাহিনী।এসবের জন্য দায়ী কে ? অবশ্যই আমরা।
রাষ্ট্রযন্ত্রকে দোষ দিলেও হবেনা।আমাদেরকে নিজেরদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে হবে।একটা গাছের পাতা যখন সব ঝরে যায় তখন গাছটি প্রায় মৃতবৎ হয়।ঠিক তেমনি একটি জাতির সংস্কৃতি যদি ধ্বংস হয় তাহলে সেই জাতির ভেতরে ভেতরে মারা যায়।যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে একদিন হয়তো আমরা শুধু চাকমা কিংবা মারমা নাম নিয়ে বেচে থাকবো কিন্তু ভেতরে কিছু থাকবে না।আরেকটা সময় হয়তো আসতে পারে যে আমরা একেবারেই নাই হয়ে গেছি।তখন হয়তো জাদুঘরে শুধু আমাদের ম্যানোকুইন গুলো থাকবে আমরা থাকবো না।বইয়ের পাতায় লেখা থাকবে একটা সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা , ত্রিপুরা নামে কিছু আদিবাসি থাকতো তারা জুম্ম নামেও পরিচিত কিন্তু বর্তমানে ডাইনোসরদের মতো কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে চিরতরে।
তখন হয়তো নৃতত্ত্ববিদেরা আমাদের ফসিলগুলো উদ্ধার করবে এবং আমাদের জীবন যাপন সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবে।
লেখক:করুণ জ্যোতি চাকমা
Comments
Post a Comment